ইচ্ছে পূরণ (ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৫ আগস্ট, ২০১৪, ০৬:৪১:৪৭ সন্ধ্যা
নিজের ছোট্ট রুম থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলেন। কিছুটা মুগ্ধ হয়েই। এরপর দরোজায় তালা লাগালেন। প্রতিবারই এমন হয়। কিছুক্ষণ নীল আকাশ ও সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া দেখলেন। মনে মনে বললেন, 'সুবহানাল্লাহ!'
বহুদিনের অভ্যাস।
এখন আপনা আপনিই মন থেকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিসমূহ দেখতে থাকলে মনের অগোচরেই তার পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায়! এর জন্য আলাদা ভাবে মুখ দিয়ে উচ্চারণের প্রয়োজন হয় না। আর মহান আল্লাহপাক এই মনকেই দেখে থাকেন... সেখানেই বসত গড়েন। কিন্তু তার জন্য চাই সাদা...স্ফটিক সদৃশ মন।
আজ দুই মাস হতে চলল গাজীপুরের এই এলাকার মসজিদের ইমাম হিসাবে আব্দুল জাব্বার সাহেব নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ফেনীর একটি প্রত্যন্ত এলাকায় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইমাম-কাম-মোয়াজ্জিন... একাই তাকে এই দুটো দায়িত্ব পালন করতে হতো। সেখানের মসজিদ কমিটি কোনোমতে তাকে খাইয়ে-পরিয়ে আর মাসিক থোক কিছু টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
এইতো একটা নাফরমানী চিন্তা করে ফেললেন!
মসজিদ কমিটির কি সাধ্য তাকে বাঁচিয়ে রাখে? আল্লাহপাক চেয়েছেন বলেই না সেখানে তার রিজিক এসেছে... সেটা পরিমাণে যাই আসুক না কেন।
মনে মনে কয়েকবার 'আস্তাগফিরুল্লাহ' (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন) পড়লেন।
তবে সাথে সাথে একথাও তার মনে পড়ল, সেই গ্রামের মসজিদে আল্লাহ পাক তার জন্য যে পরিমাণে রিজিক পাঠাতেন সেটা দিয়ে তার নিজের এবং ভোলায় তার পরিবারের প্রতি মাসের খাওয়া খরচই মিটানো মুশকিল হয়ে যেত... অন্যান্য কিছুর কথা তো বাদই দিলেন। টাকাগুলো সব কুরিয়ারে বাড়িতে পাঠাতেন। নিজের তিনবেলা খাবার এক এক দিন এক এক বাড়িতে ফিক্সড করা ছিল। ভাল-মন্দ খাওয়া হয়েই যেত। এটাও আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
তবে প্রতিবেলায় নিজের উদরপুর্তি করে ভালো ভালো খাবার খাওয়ার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত ভোলায় বৃদ্ধা মা, বউ আর তিন সন্তানের অভুক্ত চেহারাগুলো। কিন্তু খাবার নস্ট করা যাবে না ভেবে জোর করে হলেও সেগুলো গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। নিজের চোখের পানিকে মনের ভিতরের রক্তক্ষরণের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হয়েছে। পাছে তার চোখে পানি দেখে খেতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি কষ্ট পান! কতটা গরিবী হালতে রয়েছে তার পরিবার যে তিনবেলা পেটভরে খাবারও খেতে পারে না। নদী ভাঙ্গনে তাদের সহায়-সম্পদ নদীর গর্ভে চলে গিয়েছে। গুচ্ছগ্রামের বাড়ীটা পাওয়াতে তাদের মাথাগোঁজার একটা ঠাই হয়েছে। এখানে তার কাছে যে সবাইকে এনে রাখবেন, সেই সামর্থ্যও তার নেই। নিজে কোনোমতে মসজিদের সাথের ছোট্ট খুপড়িতে থাকেন। পরিবারের বাকী ৫ জনকে এনে কোথায় রাখবেন? আল্লাহপাক সবরকারীদের সাথে থাকেন। সেই সবরই তিনি করছেন। এই অজ পাড়াগাঁ এ আজ পাঁচটি বছর ধরে পড়ে থাকা কি কম সবরের কাজ?
একদিন গাজীপুরের এই মসজিদটির ইমাম নিয়োগের খবর পান আর এক পরিচিত গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সে গাজীপুরেই থাকে। তার কথামত দরখাস্ত করেন... ইন্টারভিয়্যু দেন এবং সিলেক্ট হয়ে আজ এখানে...
ভাবতে ভাবতে মসজিদ ছাড়িয়ে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলেন। আজ জুম্মাবার। আজানের এখনো ঘন্টা খানিক বাকী আছে। এখান থেকেই বাজারের শুরু। এই এলাকায় বেশ বড় একটি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। বেশ দূরে আরো কয়েকটি। এগুলোকে কেন্দ্র করেই এই এলাকাটা গড়ে উঠেছে। নচেৎ একসময় এই এলাকা ইটভাটার জন্য বিখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরী গড়ে উঠল, কাজের জন্য শ্রমিকেরা এলো... তাদের জন্য ঘর-বাড়ি বানানো শুরু হল... ইটের ভাটার ইট দিয়ে বাড়ী হল... ভাটা বিলুপ্ত হল... দোকান-পাট তৈরী হল... একসময় বড় বড় মার্কেট এবং ফ্ল্যাট বাড়ীগুলো অস্তিত্ত পেল। আর এগুলোর পাশে সেলাই দিদিমনিদের জন্য টিন শেডের গার্মেন্টস বসতি। কিছুটা বেমানান হলেও এদেরকে কেন্দ্র করেই এই জমজমাট এলাকা। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে স্বর্ণের দোকান- সবই হয়ছে। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট্ট মসজিদটিও বাড়তে থাকে। ফাউন্ডেশন দিয়ে একতলা শেষ করে এখন দুই তলার ছাদের ঢালাই চলছে। আর এ সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছেতে সবার সহযোগিতায় হয়েছে।
প্রায় ছ'ফুটের কাছাকাছি দেহ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আব্দুল জাব্বার সাহেব না চাইতেই সবার সমীহ আদায় করে নেন। একেতো ধর্মীয় নেতা (ইমামের অর্থ তাই), তার ওপর বিশাল দেহ... সম্মান তো আসবেই। কিন্তু তাকে যারা পরিচালনা করেন সেই মসজিদ কমিটির সদস্যদের কাছে নয়। এটাই এখন সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। যাদের ভিতর ন্যুণ্যতম ধর্মীয় জ্ঞান নেই, আজকাল এরাই বেশীরভাগ মসজিদের কমিটিতে পদ নিয়ে আছে। আর তার মত আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ইমামদেরকে চলতে হয় কিনা এদের নির্দেশনা মত?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুদী দোকান এর পাশের চা'র দোকানের দিকে আগাতে থাকেন। এখানের এই চা বিক্রেতা নয়ন কে বেশ ভাল লেগেছে ওনার কাছে। যা বলে সরাসরি বলে ফেলে। কাউকে ডরায়ও না, ছাড় দিয়েও কথা বলে না। ওনাকে দেখে সালাম দিয়ে বসতে বলল। এরপর চা খাবে কিনা জানতে চাইলে আব্দুল জাব্বার সাহেব সম্মতি দেন। নয়ন চা বানায় আর পাশের খদ্দেরের সাথে কথা বলতে থাকে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি পাটোয়ারী সাহেবের বলা কথা গুলো এখনো মনে আছে। একটু বেশীই মনে আছে। কারণ কথাগুলোর ভিতরে বিশেষ কিছু ছিল। তিনি বলেছিলেন, ' আপনাকে আপনার এই বিশাল দেহ দেখেই আমরা বেশী পছন্দ করেছি। কারণ ফিগার একটা বড় ফ্যাক্টর। নাহলে আপনার থেকে আরো বেশী জানলেওয়ালা ইমাম আমরা পেয়েছিলাম।'
পাটোয়ারী সাহেব সমাজ সেবা অধিদপ্তরে চাকুরী করেন। নিজের চার তলা বাড়ী আছে। সেগুলোর ভাড়া পান। আর টাকা ধার দেবার সমিতি রয়েছে। সোজা কথায় বললে 'সুদে টাকা লাগানো' হয় এই সমিতির মাধ্যমে। এলাকায় এরকম অনেক সমিতি রয়েছে। যে সকল শ্রমিকেরা এখানে চাকুরী করে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এরাই এই সকল সমিতি থেকে টাকা সুদে ধার নেয়। এভাবে এখানের স্থানীয় সকলেই এখন এক একটা সমিতির মালিক। আবার এরাই মসজিদ কমিটির সদস্য। এদের বাড়ীতেই মসজিদের ইমাম হিসাবে এক একদিন এক একজনের বাসায় আব্দুল জাব্বার সাহেবকে খেতে হয়।
ইসলাম ধর্মে আছে, হালাল খাবার খেতে হবে। অথচ সুদের কারবার যারা করে, মসজিদের ইমাম সাহেবকে তাদের বাড়িতেই খেতে হচ্ছে! আর এ ছাড়া কিছু করার ও তো নেই। তাকে যা বেতন দেয়া হচ্ছে সেটা একেবারে ফেলে দেবার মত না। গ্রামের বাড়ীর সবাইকে নিয়ে এখানে এনে রাখতে পারবেন এখন। কিন্তু এলাকার এটাই রেওয়াজ। তিনি যদি না করে দেন, তাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। নাহয় বাড়ি বাড়ি খেলেন না, কিন্তু কোনো না কোনো সময়ে তো কারো না কারো বাড়ি খেতে যেতেই হবে। তখন?
আগের ইমাম সাহেবও খুব কামেল লোক ছিলেন। এই মসজিদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে... ওয়াজ এর আয়োজন করে এই মসজিদ এতোদুর নিয়ে এসেছেন। অথচ তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল। কারণ তিনি জুমুয়ার খুতবাতে সুদের বিরুদ্ধে বলতেন। কমিটির লোকেরা ওনাকে এই ব্যাপারে না বলার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারো কথাই শুনলেন না। অবশেষে তাকে চলে যেতে হল।
চা খেয়ে বিল দিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলেন। আজানের আর বেশী বাকী নেই। পথে দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। অর্ধনগ্ন নারীদেহের রঙিন ছবি। এরকম কিছুদুর পরপর রয়েছে। সেদিকে চোখ চলে গেলেও দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সাধারণ পাবলিকের সাথে এখানেই তার পার্থক্য। দীর্ঘদিনের অনুশীলন বলে কথা। হাঁটতে হাঁটতে পাটোয়ারী সাহেবের আর একটি কথা মনে পড়ল। প্রথম দিন অনেক কিছুর সাথে তাকে এই কথাটিও বলেছিলেন, ' আপনি ইমাম। মানুষের আখিরাতের মুক্তির জন্য কোরআন হাদিসের আলোকে বয়ান করবেন। সেটা আপনার এক্তিয়ার। কিন্তু সুদের বিষয়টি বাদ দিয়ে বয়ান করবেন। আমাদের এই এলাকার বেশীরভাগ মানুষই হয় সুদের ব্যবসা করে, না হয় সুদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন এই বিষয়ে আলোচনা করলে সকলেরই শরীরে লাগে।' একবার চিন্তা করলেন এ কথা বলবেন,' তবে এই ব্যবসা বাদ দিচ্ছেন না কেন?'
কিন্তু অনেক কিছু চাইলেই আমরা বলতে পারি না।
যখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, না, এভাবে নিজেকে ছোট করে ইমামতি করা যায় না। তখনই ফেনীর সেই ৫ বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা মনে পড়ে যায়... ইমাম হবার পরও তাকে জমিতে বলদ নিয়ে চাষে সাহায্য করতে হয়েছে... জায়গীর থাকার মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে দিনের পর দিন বিনা বেতনে পড়াতে হয়েছে... মসিজদের দেখাশুনা করা তো ছিলই। আর পরিবারের সবাইকে ফেলে একা একা থাকা... দিনের পর দিন! আহ! অসহ্য যন্ত্রনাকর সেই দিনগুলোকে ফেলে এখন যখনই না একটু সুদিন আসি আসি করছে, তিনি কি নিজের বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে সেটিকে পায়ে মাড়িয়ে আবার সেই কষ্টকর দিনগুলোতে ফিরে যাবেন? মা-বউ ও তিন বাচ্চাকে এখানে সামনের মাসে নিয়ে আসবেন চিন্তা করেছেন। পাটোয়ারী সাহেব একটা দুরুমের বাসাও তার জন্য অল্প ভাড়াতে ঠিক করে দিয়েছেন। পাশেই স্কুল আছে। সেখানে ছেলেমেয়ে তিনজনকে ভর্তি করাতে পারবেন। একটা মাদ্রাসা করার চিন্তা করেছে মসজিদ কমিটি, সেটাও তাকে চালাতে হবে। সেদিক থেকেও কিছু টাকা আসবে। আর সকালে এখন তার কাছে প্রায় ২০-২৫ জনের মত আরবী পড়ছে। সেখান থেকেও অনেক টাকা আসছে।
এই সব কিছুকে ছেড়ে যেতে হবে একেবারে খালি হাতে যদি কমিটির সদস্যদের কথার বাহিরে নিজের বিবেকের কথা মত চলেন।
কি হবে আবার ফিরে গেলে?
মাকে ফোনে সেদিন বলেছেন, ' চিন্তা কইরো না। আমার কাছে তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি। আর কষ্ট করা লাগবে না।' মা এর হাসিমুখ এতো দূর থেকেও তিনি দেখতে পেরেছেন। বউ এর খুশী অনুভব করতে পারছেন। ছেলেমেয়েদের বাবার কাছে আসার... একটু পেট ভরে খেতে পারার আনন্দকে নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন।
এসবই স্রেফ উবে যাবে!
তার একটি সিদ্ধান্তের দ্বারা।
মসজিদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জুতো জোড়া হাতে নিতে নিতে ভাবলেন, একটা হাহাকার জীবনে সবসময় থেকেই যায়। সেটাকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না। দারিদ্র্যতা জীবনের একটা অলংকারের মত তার জীবনে রয়েই গেলো। তবে যে এই দারিদ্র্যতাকে মেনে নিতে পেরেছে, তাকে কখনো শান্তির পিছনে ছুটতে হয় নাই। বরং শান্তিই তার পিছু নেয়। একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে মিম্বরের দিকে চলে যান। আজান দিতে হবে।
পুরো মসজিদে পিনপতন নীরবতা না থাকলেও মোটামুটি সকলেই নীরব। এই নতুন ইমাম এর কথার ভিতরে একরকম যাদু আছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে। খুৎবার আগে ইমাম সাহেব বাংলায় কিছু বয়ান করেন। এখন সেটাই দিতে যাচ্ছেন নতুন ইমাম আব্দুল জাব্বার সাহেব। তিনি সালাম দিয়ে শুরু করলেন,
: আল্লাহ পাক সুদকে হারাম করেছেন... আর যাকাতকে ফরয করেছেন...
বিষয়: সাহিত্য
৯৬৬ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পাশের গ্রামের রুস্তম-
এরা সবাই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
আব্দুল জব্বার সাহেবের খোজে আমি দিশেহারা,
সত্যি তাঁর খুব প্রয়োজন।
তরীর কান্ডারীর চোখে রুমাল বেধে,এই পাটোয়ারী/রুস্তম রা তরী ফুটো করছে।
তরী বাচাঁতে আল্লাহ যেন প্রতিটি মসজিদের ইমাম করে জব্বার সাহেবকে পাঠান।কোন এক মসজিদের জব্বার ভাইয়ের উপযুক্ত সাথী হিসেবে আল্লাহ পাক আমার লেখক ভাইকে কবুল করে নিন।আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন